আয়ুর্বেদিক ঔষধের উপকারিতা

আয়ুর্বেদ, যা প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি ভেষজ চিকিৎসা ব্যবস্থা। দুইটি সংস্কৃত শব্দ “আয়ুষ” এবং ‘'বেদ” এর সমন্বয়ে এটি সৃষ্ট। আয়ুষ শব্দের অর্থ জীবন এবং বেদ শব্দের অর্থ বিজ্ঞান অর্থাৎ আয়ুর্বেদ শব্দের অর্থ জীবনের বিজ্ঞান।
আয়ুর্বেদিক ঔষধের উপকারিতা
এই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে প্রাকৃতিকভাবে রোগ নিরাময় করা।

আয়ুর্বেদ কি

আয়ুর্বেদ হলো ৫০০০ হাজার বছরের পুরোনো ভারতীয় বৈদ্যক চিকিৎসা শাস্ত্র। এই ঔষধের মূলমন্ত্র হলো শরীরের দোষ (যেমনঃ বায়ু, পিত্ত এবং কফ) ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে শারীর এবং মননের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।


এছাড়াও শরীরের আরও ৩টি মূল উপাদান রয়েছে। যেমন: ধাতু, মল ও অগ্নি। সর্বমোট এই ৪টি মূল উপাদানের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:- 

দোষ

আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র অনুযায়ী, শরীরে তিনটি প্রাথমিক দোষ বিদ্যমান। এই তিনটি দোষ হল:

বাত (Vata): বাত সাধারণত শরীরের শ্বাস-প্রশ্বাস, স্নায়বিক কার্যক্রম এবং রক্ত সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে। বাত দোষ বৃদ্ধি পেলে অস্থিরতা, উদ্বেগ, অনিদ্রা এবং ত্বক শুষ্ক হতে পারে।

পিত্ত (Pitta): পিত্ত সাধারণত হজম, বিপাক, দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ করে। পিত্ত দোষ বৃদ্ধি হলে প্রদাহ, অম্লতা, চুল পড়া এবং রাগ হতে পারে।

কফ (Kapha): কফ সাধারণত শারীরিক কাঠামো, ইমিউন সিস্টেম এবং মনোসংযোগ নিয়ন্ত্রণ করে। কফ দোষ বৃদ্ধি হলে স্থূলতা, অলসতা, ঠাণ্ডা এবং শ্লেষ্মা হতে পারে।

ধাতু

এই শাস্ত্রে ধাতু হলো দেহের সাতটি মৌলিক টিস্যু, যা দেহের শারীরিক কাঠামো এবং কার্যক্রম বজায় রাখতে সহায়ক। এই সাতটি ধাতু হলো:

  • রস 

  • রক্ত

  • মাংস 

  • মেদ 

  • অস্থি 

  • মজ্জা 

  • শুক্র 

মল

এই শাস্ত্রে "মল" হল শরীরের বর্জ্য পদার্থ যা নিয়মিত এবং সঠিকভাবে নিষ্কাশন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনটি প্রধান মল হলো:

পুরীষ (Puris): মল যা হজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে অপসারণ হয়।

মূত্র (Mutra): প্রস্রাব যা কিডনি থেকে ফিল্টার করা বর্জ্য পদার্থ।

স্বেদ (Sweda): ঘাম যা ত্বকের মাধ্যমে শরীর থেকে অপসারণ হয়।

অগ্নি

এই শাস্ত্রে "অগ্নি" হল দেহের হজম এবং বিপাকীয় শক্তি যা পুষ্টি শোষণ এবং বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয়। বিভিন্ন প্রকার অগ্নি রয়েছে:


  • জাঠর অগ্নি 

  • ধাতু অগ্নি 

  • ভূত অগ্নি

রোগ প্রতিরোধে আয়ুর্বেদের ভূমিকা 

বলা হয়ে থাকে নিয়মিত আয়ুর্বেদ ব্যবহারে রোগ থাকে না শরীরে এবং পড়ে না বয়সের ছাপ! কি রয়েছে এর উপাদানের ভেতরে? চলুন জেনে নেই! 


ঔষধ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। প্রধানত উদ্ভিদ, খনিজ এবং প্রাণীজ উপাদান থেকে এটি প্রস্তুত করা হয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো:


  • উদ্ভিদজাত উপাদান: বিভিন্ন ধরনের গাছ, পাতা, ফুল, ফল, শিকড়, এবং বীজ।

  • খনিজ উপাদান: সোনা, রূপা, লোহা, এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ।

  • প্রাণীজ উপাদান: বিভিন্ন প্রাণীর দুধ, মধু, এবং অন্যান্য জীবাণু নির্যাস।


বিভিন্ন রোগের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় নিম্নোক্ত  উদ্ভিদজাত ফলগুলো ব্যবহার করা হয়। যেমন:- 

আমলকী

আমলকী, যা আমলা বা ইন্ডিয়ান গুজবেরি নামেও পরিচিত। আমলাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় ‘'বয়স্থা” অর্থাৎ বয়স আস্থাপক। তাই যারা নিয়মিত আমলকি খায় তাদের বয়স কেউ বুঝতেই পারবে না। এটি উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। আমলকী হজম প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধি করে। এটি ত্বক ও চুলের যত্নে কার্যকরী এবং রক্ত পরিষ্কার করে। 


এছাড়াও আমলকী দেহের টক্সিন মুক্ত এবং লিভার কার্যক্রম বৃদ্ধি করে। এটি রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

হরিতকী

আরো একটি পরিচিত ফল হরিতকী। এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবে পরিচিত। হরিতকী হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা নিরাময়ে সহায়ক এবং দেহের টক্সিন নির্গমন করে। এটি শরীরের দোষ বা দোশ ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক এবং মনোভাব উন্নত করে।


এছাড়াও হরিতকী মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি দেহের শক্তি এবং সহনশীলতা বাড়ায়, যা দৈনন্দিন কার্যক্রমে সহায়ক।

বহেরা

বহেরা, যা ভিভিতাকি নামেও পরিচিত। এটি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। বহেরা হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা কমাতে ব্যবহৃত হয়। এটি রক্ত পরিষ্কার করে এবং দেহের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এটি লিভার এবং কিডনির কার্যক্ষমতা উন্নত করে এবং দেহের বিষাক্ত পদার্থ অপসারণে সহায়ক। এটি ত্বকের সমস্যা দূর করতে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

ত্রিফলা

ত্রিফলা হলো উপরে উল্লেখিত তিনটি ভেষজ ফলের (আমলকী, হরিতকী, বহেরা) সমন্বয়ে গঠিত ভেষজ ঔষধ। এটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং দেহের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। ত্রিফলা হজম প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করে, রক্ত পরিষ্কার করে এবং শরীরের টক্সিন নির্গমন করে। ত্রিফলা নিয়মিত সেবনে দেহের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।


এছাড়াও, ত্রিফলা বার্ধক্যজনিত সমস্যা কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরের সজীবতা বজায় রাখে। এটি দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং পেটের সমস্যা কমাতে সহায়ক।

ব্রাহ্মী


ব্রাহ্মী, যা বাকোপা মোনিয়েরি নামেও পরিচিত। ব্রাহ্মী স্ট্রেস এবং উদ্বেগ কমায়। এটি মনোযোগ এবং শিখন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদন বাড়ায় এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ব্রাহ্মী শরীরের সার্বিক স্বাস্থ্য রক্ষা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

রসুন

হাতের কাছে পাওয়া সবচেয়ে উপকারী একটি ভেষজ ঔষধ। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা রোজ সকালে এক কোয়া রসুন খেয়ে দেখুন ম্যাজিক! এছাড়াও রসুন উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে। 

প্রাচীন বিজ্ঞানের আধুনিক ব্যবহার 

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরোনো। এই প্রাচীন বিজ্ঞানকে আধুনিক উপায়ে প্রসেস করে মানুষ ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কিভাবে ব্যবহার করছে? চলুন জেনে নেই। 


প্রাকৃতিক ঔষধ ও সাপ্লিমেন্ট

আয়ুর্বেদিক ঔষধ এবং সাপ্লিমেন্ট আধুনিক যুগে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং কোম্পানি আয়ুর্বেদিক উপাদান থেকে তৈরি ঔষধ এবং ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট তৈরি করছে যা রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ:


আশ্বগন্ধা: মানসিক চাপ কমাতে এবং শারীরিক শক্তি বাড়াতে ব্যবহৃত হয়।


তুলসী: ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক।


স্কিনকেয়ার ও কসমেটিক্স


আধুনিক সময়ে এই উপাদানগুলি ত্বক ও চুলের যত্নে ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক কসমেটিক্স এবং স্কিনকেয়ার পণ্যগুলিতে আয়ুর্বেদিক উপাদান যেমন:


নিম: এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং এন্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবে ত্বকের সমস্যা দূর করতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ত্বক ভালো রাখতে তেল মালিশ ও এই স্কিনকেয়ারের অন্তর্ভুক্ত। 


হলুদ: ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়ক।


খাদ্য ও পুষ্টি


খাদ্যাভ্যাস এবং পুষ্টি নির্দেশিকা আজকাল অনেক জনপ্রিয়। বিভিন্ন ডায়েট প্ল্যান এবং পুষ্টি নির্দেশিকায় আয়ুর্বেদের মূলনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে:


সুষম খাদ্য: দেহের দোষ অনুযায়ী সুষম খাদ্য গ্রহণ।


ডিটক্স ডায়েট: শরীরের বিষাক্ত পদার্থ মুক্ত করতে নিয়মিত ডিটক্স ডায়েট করা উচিৎ। 


যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন


আয়ুর্বেদের অংশ হিসেবে যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন বা ধ্যান আজকাল অনেক জনপ্রিয়। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে যোগ এবং মেডিটেশন অনুশীলন অনেকেই করে থাকেন:


যোগব্যায়াম: শারীরিক স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক।


প্রাণায়াম: শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসিক শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখা।


আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার সংমিশ্রণ অনেক ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হচ্ছে। কিছু চিকিৎসা পদ্ধতিতে আয়ুর্বেদিক ঔষধ এবং আধুনিক চিকিৎসা একসাথে ব্যবহার করা হয়, যেমন:


ক্যান্সার চিকিৎসা: ক্যান্সার রোগীদের জন্য আয়ুর্বেদিক ঔষধ ব্যবহৃত হয় যাতে তাদের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী থাকে এবং চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানো যায়।


ডায়াবেটিস চিকিৎসা: ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে আয়ুর্বেদিক ঔষধ ব্যবহৃত হয়।

আয়ুর্বেদিক ঔষধের উপকারিতা

আয়ুর্বেদিক ঔষধের প্রধান উপকারিতা হলো এটি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি। তাই এটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত এবং নিরাপদ। এই চিকিৎসা দেহের সম্পূর্ণ অংশকে গুরুত্ব দেয়, যা রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতিতে সহায়তা করে। এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে, হজম প্রক্রিয়া বাড়ায়, মানসিক চাপ কমায় এবং শারীরিক শক্তি বাড়ায়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

লার্নিং পয়েন্ট ২৪ নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url